স্বদেশ ডেস্ক:
বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম বড় দুর্ঘটনা তাজরীন ফ্যাশনস-এ অগ্নিকাণ্ডের ১০ বছর শেষ হচ্ছে আজ। ২০১২ সালের এই দিনে সাভারের ওই পোশাক কারখানাটিতে যে অগ্নিকাণ্ড হয়, তাতে কারখানার মধ্যে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১১০ জন শ্রমিক। এছাড়াও আহত হয়েছিলেন শত শত মানুষ।
অগ্নিকাণ্ডের সময় কারখানাটিতে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল।
শ্রমিকরা বলছেন, গত ১০ বছরে তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ এবং দীর্ঘমেয়াদে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কিন্তু সরকার এবং বিজিএমইএ দাবি করেছে, বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দুর্দশা কমেনি এখনো।
সাভারের নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সেখানে তালা ঝুলছে, ভেতরে সাধারণ মানুষজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এলাকার সাধারণ মানুষেরা জানিয়েছেন, বছরের কেবল নভেম্বর মাসেই কারখানায় তালা মারা হয়। বাকি সময় কারখানা চত্বরে মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠানের ট্রাক-ভ্যান বা লরি রাখা হয়। সাথে স্থানীয় মানুষেরা মৌসুমে ধান শুকান। সবই যেনো স্বাভাবিক।
‘আমার এই বাম হাতটা ভাঙা, এখনো বাঁকা আছে’ অগ্নিকাণ্ডের সময় সুইং অপারেটর নাসিমা বেগম তিনতলা থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কারখানার সামনে তিনি হেটেই এসেছিলেন। তিনি বলেন, ১০ বছরেও আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন শরীরে, যে কারণে কোনো কাজকর্মও করতে পারেন না, ফলে আয় রোজগারও নেয়।
তিনি বলেন, ‘আমার এই বাম হাতটা ভাঙা, এখনো বাঁকা আছে, সোজা হয় নাই। হাতের এই মাংসটুকু কাইট্যা পইড়া গেসিলো ওয়ালের ঘষা লাইগ্যা, মেরুদণ্ডের হাঁড় ফাইট্যা গেসে, ঘাঁড়ের হাঁড়টা ফাটা আছে, মাথায় আঘাত পাইছিলাম, আমি কিন্তু ঠিকমতো দেখতে পাই না।’
নাসিমা বেগম জানান, চিকিৎসক জানিয়েছেন সারা জীবন-ই এসব আঘাতের চিকিৎসা করিয়ে যেতে হবে তাকে।
কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ১০ বছর পূর্তিকে কেন্দ্র করে নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে বুধবার শ’ খানেক আহতত শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন। যাদের একজন ছিলেন নাসিমা বেগম।
সেখানে আসা শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি দকরছিলেন।
‘এইটারে জীবন বলে না’
অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়া আলেয়া বেগম বলছিলেন, ১০ বছর পার হয়ে গেলেও কোনো নিহত বা আহত ব্যক্তির পরিবার এখনো কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। জীবন যুদ্ধে টানাপোড়েনের কাহিনী বলতে গিয়ে হতাশার কথা জানান তিনি।
আলেয়া বেগম বলেন, ‘১০ বছর হয়ে গেছে, হয়তো তাজরীনের আগুন নিভে গেছে, আমাদের মনের আগুন নিভে নাই। কারণ আমরা ধুঁকে ধুঁকে মরার চাইতে, ওইখানে মরলে তাও আমরা শহীদি মরা হইতাম।’
এখন যে জীবনটা কাটতেসে এইটা মানুষের করুণার জীবন, এইটাকে জীবন বলে না। না কোনো কাজ করতে পারতেছি, পোলাপান লেখা-পড়া করতে দিতে পারতেছি না, কোনো কিছুই করতে পারতেছি না, এইটারে জীবন বলে না।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি মত
রানা প্লাজা ধসের কয়েক মাস আগে ঘটা তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের শিল্পকারখানার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কয়েক দফায় ক্ষতিপূরণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে ২০১২ সালেই অগ্নিকাণ্ডের ১০দিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহত ও আহত সব শ্রমিকের পরিবারকে অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ছয় লাখ টাকা আর আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
২০১৩ সালে তাজরীন এবং রানা প্লাজা ধসে নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে জেনেভায় ইন্ডাস্ট্রি-অল আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সাথে একটি বৈঠক ডেকেছিল। তাতে শ্রমিকদের তিন মাসের সমপরিমাণ অর্থ প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছিল। সে বৈঠক সফল না হলেও, কয়েকটি ব্র্যান্ড মিলে ২০১৬ সালে শ্রমিকদের অর্থ সহায়তা দিয়েছিল।
এদিকে, তৈরি পোশাক মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, তারা দুর্ঘটনার পর পরই শ্রমিকদের সহায়তা করেছেন।
বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘না না, যা করার তখনই করা হইছে, সবাইকে দেয়া হইছে। নিয়ম অনুযায়ী সবাইকে দেয়া হইছে, শ্রম আইন অনুযায়ী সবাইকে দেয়া হইছে।’
ওই দুর্ঘটনায় সেদিন বেঁচে যাওয়া অনেক শ্রমিক নতুন করে জীবন শুরু করেন।
তবে যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। তারা বলছেন, এ পর্যন্ত যা অর্থ সাহায্য পেয়েছেন, সেটি ক্ষতিপূরণ নয়। তারা যা পেয়েছেন সেটি অনুদান এবং চিকিৎসা খাতে সাহায্য।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান বলেছেন, নতুন করে এই শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার সুযোগ নেই, কারণ তাদের ইতোমধ্যে যথেষ্ঠ অর্থসহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক দফা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। লেবার মিনিস্ট্রি দিয়েছে এক কোটি, শেখ হাসিনা দিছেন একেক জনকে পাঁচ লাখ করে, মালিকরা দিয়েছে দু’লাখ করে।
সূত্র : বিবিসি